গল্প- শীতল পরশ

শীতল পরশ
– মুনমুন রাহা

 

আজ রায় বাবুদের বাড়িটা সেজে উঠেছে আলোয় আলোয়। আনন্দমুখরিত পরিবেশ। সবাই এমন এলাহি আয়োজনে ধন্য ধন্য করছে। পাড়া প্রতিবেশি থেকে আত্মীয়, সবার মুখেই ভেনু থেকে মেনুর প্রশংসা। হবে নাই বা কেন রায়বাবুর একমাত্র ছেলে নীলাদ্রির বৌভাত আজ । রায়বাবু যে বিস্তর সম্পত্তির মালিক তা সবাই জানে তাই তার ছেলের বিয়েতে এমন আয়োজনই প্রত্যাশিত।
কেবল আয়োজন দেখেই নয়, লোকে প্রশংসা করছে নীলাদ্রির বৌ তাপসীরও। রঙে , রূপে, শিক্ষায় সব কিছুতেই অসামান্য সে। নীলাদ্রি আর তাপসী, যেন মেড ফর ইচ আদার। কেবল নীলাদ্রি আর তাপসীই নয় মিল আছে ওদের পরিবারেও। নীলাদ্রির মতো তাপসীরাও খুব বড়লোক। কানাঘুষো এটাও শোনা যাচ্ছে বড়লোক বাবার একমাত্র মেয়েকে নীলাদ্রির বিয়ে করার কারণ হচ্ছে তাপসীর বাবার সম্পত্তি। যার মালিক হয়তো ভবিষ্যতে বকলমে নীলাদ্রিই হবে।
অতিথিরা ফিরে গেছে যে যার বাড়ি। তাপসী ফুলের সাজে অপেক্ষা করছে নীলাদ্রির জন্য। প্রথম রাতের উত্তেজনা আর ভয় দুটোই গ্রাস করছে তাকে। ঘরে এসে ঢুকল নীলাদ্রি । তার অবশ্য তেমন ভয় বা উত্তেজনা কোনটাই নেই। কারণ সে বিছানায় এর আগেও বহুবার খেলেছে। সে এবিষয়ে পাকা খেলোয়াড়। আস্তে আস্তে সে এগিয়ে যায় তাপসীর দিকে। মুখটা তুলে ধরে তারপর তার কোমোল ঠোঁটে একটা গভীর চুম্বন এঁকে দেয়। তাপসী তার জীবনের প্রথম পুরুষের ছোঁয়াতে কেঁপে ওঠে। লজ্জায় রাঙা হয়ে নীলাদ্রির বুকে মুখ লুকায়।

নীলাদ্রি আরও শক্ত করে তার বাহুডোর। নীলাদ্রির হাত খেলা করে তাপসীর পিঠের উপর আস্তে আস্তে নামতে থাকে হাত শিরদাঁড়া বেয়ে কোমর পর্যন্ত আসতেই তাপসী হাত সরিয়ে দেয় নীলাদ্রির। লজ্জায় আরক্ত হয়ে বলে, চেঞ্জ করে আসি। নীলাদ্রি আরও একবার বুকে টেনে নেয় তারপর পকেটে রাখা হীরের আংটিটা পরিয়ে দেয় তাপসীর অনামিকাতে আর হাতে একটা প্যাকেট দেয়। বলে, আজকের রাতের জন্য স্পেশাল নাইট ড্রেস। তাপসী হেসে চলে যায় বাথরুমে চেঞ্জ করতে।

নীলাদ্রি ব্যালকনিতে এসে একটা সিগারেট ধরাল। মনটা তার ভারী ফুরফুরে লাগছে আজ। সুন্দরী বৌ আর সাথে তার অগাধ সম্পত্তি, আর কি চাই জীবনে। হঠাৎই ঘরের লাইটটা অফ হয়ে যায়। নীলাদ্রি দেখে রাস্তার আলোগুলো সবই জ্বলছে কেবল অন্ধকারে ঢেকে গেছে তার ঘরখানা। নিশ্চয়ই শর্ট সার্কিট। দেখতে যাবে বলে ব্যালকনি থেকে ঘরে আসে। ঘরের বাইরে বেরোনোর আগেই পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে একটা মেয়েলি হাত, হাতটা হীম শীতল। বোধহয় সবে স্নান সেরেছে বলে । নীলাদ্রি ঘুরে দাঁড়ায়। অন্ধকারে ভাল করে না দেখা গেলেও রাস্তার আবছা আলোয় বোঝা যাচ্ছে নীলাদ্রির দেওয়া লাল ফিনফিনে নাইট ড্রেসটা। নীলাদ্রি আর দেরি করে না । তাকে কোলে নিয়ে সোজা বিছানায় চলে যায়।
নীলাদ্রি বিছানায় নিয়ে গেলেও নীলাদ্রি কিছু করার আগেই সে ঝাঁপিয়ে পড়ে নীলাদ্রির উপর। ঠান্ডা হাতটা দ্রুত নিরাভরণ করে নীলাদ্রিকে। তারপর দখল নেয় তার শরীরের উপর। এক মিনিট, দুই মিনিট, পাঁচ মিনিট… ছিটকে উঠে নীলাদ্রি একি! এ ছোঁয়া যে তার বড় চেনা। এই স্পর্শ সে তো ভুল করবে না! এ যে নয়নার স্পর্শ। এই উন্মাদনা তো নয়নার স্পর্শে সে পেত! কিন্ত নয়না! কিভাবে, কিভাবে সম্ভব! এবার দিল্লী থেকে পাকাপাকি কোলকাতায় আসার সময়েই তো নিজের হাতে গলা টিপে মেরে এসেছে নয়নাকে। বডিটারও ঠিকানা লাগিয়ে এসেছে। তাহলে , তাহলে! এসব কি হচ্ছে!

ভাবনার মধ্যেই ঠান্ডা শরীরটা আবার দখল করেছে নীলাদ্রিকে। নীলাদ্রি চাইলেও নিজেকে ছাড়াতে পারছে না। অতিমানবিক শক্তির কাছে পরাস্ত সে। তার সর্বাঙ্গ লেহন করছে সাপের মতো ঠান্ডা শরীরটা। নীলাদ্রির মনে পড়ে ঠিক এইভাবেই নয়নাকে আদর করতে বাধ্য করত নীলাদ্রি। প্রথমে সে আদর করত নয়নাকে তারপর নয়নাকে বলত তাকে এইভাবে আদর করতে। নয়না লজ্জা পেত, সংকোচ করত। কিন্ত নীলাদ্রি বলত এই খেলাতে কেবল ছুঁতে ভাল লাগে না অন্যজনের ছোঁয়াতেও ভালো লাগে।

নীলাদ্রিদের দিল্লীর অফিসে মাঝারি পোস্টে চাকরি করত নয়না। প্রথম দিকে তেমন ভাবে নীলাদ্রির নজরেও পড়েনি সে। একদিন বৃষ্টির রাতে অফিসের বাইরে নয়নাকে একা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে লিফট্ দেয় নীলাদ্রি। অফিসের বসের যাচা লিফট্ অগ্রাহ্য করার মতো ক্ষমতা ছিল না নয়নার। তারপর নীলাদ্রি শুরু করে তার প্রেমের অভিনয়। যা এর আগেও সে বহুবার করেছে মেয়েদের বিছানায় তুলতে। নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে নয়নার সংস্কার একটু বেশিই ছিল। তাই খানিক সময় লাগে তাকে পার্ক, রেস্টুরেন্ট থেকে বিছানায় তুলতে । নয়না বিয়ের আগে নিজেকে সঁপে দিতে চায় নি নীলাদ্রির হাতে। কিন্ত নয়না আপত্তি জানালেই নীলাদ্রি সম্পর্ক ভেঙে দেওয়ার ভয় দেখাত, তাতেই নয়না কাবু হয়ে যায়। কারণ নীলাদ্রি অভিনয় করলেও নয়না কিন্ত প্রাণ দিয়ে ভালবেসেছিল নীলাদ্রিকে। দিল্লীতে ভালোই টাইম পাশ কাটছিল নীলাদ্রির। কিন্ত শেষের দিকে নয়না খালি ঘ্যানঘ্যান করত বিয়ের জন্য। তারপর যেদিন নয়না জানাল সে নীলাদ্রির বাচ্চার মা হতে চলেছে এবং এই বাচ্চা সে কিছুতেই নষ্ট করবে না। দরকার হলে নীলাদ্রির বাবা মাকে সব জানাবে, সেদিন আর নীলাদ্রি কোন রিস্ক নেয়নি। ততদিনে নীলাদ্রির বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে তাপসীর সঙ্গে। নীলাদ্রি বোঝে নয়নার এই পদক্ষেপে বাধা পড়তে পারে তাপসীর সাথে বিয়েটা। তাই নয়নাকে সেই রাতেই গলা টিপে মারে সে।

নীলাদ্রির ঘুম ভাঙাল তাপসীর ডাকে। হাতে চায়ের কাপ নিয়ে তাপসী বলে, ওঠো এবার, নীচে সবাই আমাকে কত খ্যাপাচ্ছে জানো, তুমি বেলা পর্যন্ত ঘুমাচ্ছ বলে! মুখে একটা দুষ্টু হাসি খেলে যায় তাপসীর। নীলাদ্রি তাপসীর মুখের দিকে একবার তাকিয়ে বলে, আচ্ছা কাল রাতে তুমি কিছু টের পেয়েছিলে? মানে, কাল রাতে কি হয়েছিল মনে আছে তোমার? তাপসী হেসে বলে, না গো কিচ্ছু মনে নেই। কাল এত ক্লান্ত ছিলাম কখন যে বাথরুম থেকে ঘরে এসেছি আর ঘুমিয়ে পড়েছি মনেই নেই। সকালে দেখলাম তুমি পাশে ঘুমাচ্ছ ! নীলাদ্রির মাথায় কিছু ঢুকছে না। তাহলে কি হল কাল রাতে! তার যে অনুভূতি সেগুলো কি তবে সব কল্পনা! কিন্ত কল্পনা এত স্পষ্ট হয় কি?
মনের সব দ্বন্দ্ব কাটিয়ে রাতের ঘটনাটা কল্পনা বলেই মেনে নেয় নীলাদ্রি। সকালটা ভালোই কাটে। কোন অস্বাভাবিকতার লেশ মাত্র নেই। তাই নীলাদ্রি আরও নিশ্চিত হয় রাতের ঘটনা কল্পনা ছাড়া কিছু নয় বলে। কিন্ত রাতে সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটল। সেই অন্ধকার, সেই লাল ফিনফিনে রাত পোষাক, সেই ঠাণ্ডা শরীরের ছোঁয়া, সেই সাপের মতো সর্বাঙ্গ লেহন, নীলাদ্রির শরীরের উপর ঠান্ডা শরীরটার আধিপত্য বিস্তার। তাপসীর রাতের কোন স্মৃতি না থাকা। একরাত নয় দু’ রাত নয়, প্রতিরাতে একই ঘটনা ঘটতে থাকে। কিন্ত সমস্যা হল নীলাদ্রির এই কথা কেউ বিশ্বাস করে না। সবাইভাবে নীলাদ্রি ভুল বকছে। আর তাপসী নিশ্চয়ই খুব ক্লান্ত থাকে তাই কখন ঘুমিয়ে পড়ে খেয়াল থাকে না তার। অবশ্য তাপসীর নিজেরও তাই ধারণা। শুধু ওর একটাই অস্বাভাবিকতা লাগে প্রথম রাতে নীলাদ্রির দেওয়া নাইট ড্রেসটা এত করে খোঁজার পরও খুঁজে পায় না সে।

কেটে গেছে একটা বছর। এই একটা বছরে পাল্টে গেছে অনেক কিছু। নীলাদ্রি এখন বদ্ধ উন্মাদ। তাপসীর সাথে ডিভোর্স হয়ে গেছে তার । নীলাদ্রি যতবার রাতের অভিজ্ঞতার কথা তাপসীকে বলেছে ততবারই তাপসীর মনে হয়েছে নীলাদ্রির মাথায় নিশ্চয়ই কোন দোষ আছে। নীলাদ্রি প্রতিরাতের অত্যাচারে আর সবার অবিশ্বাসে দিশেহারা হয়ে পড়ে। আস্তে নীলাদ্রির আচরণে পাগলামোর লক্ষণ দেখা যায়। নীলাদ্রিকে নিয়ে ওর বাবা সাইকোলজিস্টের কাছেও গিয়েছিল কিন্ত লাভ হয় নি কিছু। ডাক্তারের দেওয়া কড়া ঘুমের ওষুধেও ঘুম হয় না তার। এখনও প্রতিরাতে তাকে সহ্য করতে হয় ঐ ঠান্ডা শরীরের ছোঁয়া। সেই ছোঁয়া যেন প্রতিরাতে নীলাদ্রিকে বুঝিয়ে দেয় অযাচিত ভাবে ছুঁলে ঠিক কেমন লাগে। প্রতিরাতে নীলাদ্রিকে শাস্তি পেতে হয় তার কৃতকর্মের। কতদিন পেতে হবে তা জানা নেই, হয়তো আজীবন নীলাদ্রিকে ভোগ করতে হবে ঠান্ডা শরীরের স্পর্শ।

Loading

Leave A Comment